মনুস্মৃতি অধ্যায় এক শ্লোক সংখ্যা ৭ থেকে ৯
অনুবাদ
যিনি ইন্দ্রিয়ের অতীত, সূক্ষ্ম, অব্যক্ত, চিরন্তন এবং সমস্ত জীবের মধ্যে বিরাজমান, সেই অচিন্তনীয় সত্তা নিজেই প্রকাশিত হলেন। তিনি প্রজা সৃষ্টির ইচ্ছায় নিজের শরীর থেকে জল সৃষ্টি করলেন এবং সেই জলে বীজ নিক্ষেপ করলেন। সেই উজ্জ্বল অণ্ড (ব্রহ্মাণ্ড) উৎপন্ন হল, যা সূর্যকিরণসম উজ্জ্বল। সেই অণ্ডেই স্বয়ং ব্রহ্মা, সমস্ত লোকের পিতামহ, অবস্থান করলেন।
ব্যাখ্যা
ব্রহ্মাণ্ডের শুরুতে একটি অভৌতিক (non-material), অচিন্তনীয় সত্তা ছিলেন। যাহাকে আমরা পর ব্রহ্ম বলি। সেই ব্রহ্ম নিজেকে অবর ব্রহ্ম (সাকার ব্রহ্ম) রূপে প্রকট করেছেন। সেই সাকার ব্রহ্মের স্বেদ থেকে একটি সমুদ্র তৈরী হলো, অর্থাৎ সৃষ্টির প্রথম জল প্রকট করলেন। সেই জলে “বীজ” নিক্ষেপের অর্থ সৃষ্টির প্রাণশক্তি বা চেতনা সঞ্চার করলেন। নিজের শক্তি দ্বারা জল এবং সেই জলে তিনি যে বীজ নিক্ষেপ করলেন — যার থেকে সমস্ত সৃষ্টির সূত্রপাত। অর্থাৎ কারণ ও কারক এক ও অভিন্ন।
সংস্কৃত শব্দ “অণ্ড” (aṇḍa) মানে ডিম্বাকার কিছু। শাস্ত্রে একে “হিরণ্যগর্ভ” (Hiranyagarbha) বলা হয় — সোনালি ডিম। এটিকেই বলা হয় Cosmic Egg। এই ধারণা প্রাক-বিজ্ঞান যুগের কসমোলজি। ভারতীয় শাস্ত্র, মিশরীয় পুরাণ, গ্রীক মিথ—সব জায়গায় এর ছায়া দেখা যায়।
মিশরীয় কসমোলজিতে, শুরুতে ছিল "Nun" — এক অসীম জলীয় শূন্যতা। সেই জল থেকে “Atum” নামক একটি সত্তা আত্ম-সৃজিত হয়ে উঠে আসে। Atum তার থেকেই সৃষ্টি করে পৃথিবী, আকাশ, দেবতা। গ্রিক অরফিক মিথোলজি-তে বলা হয়:শুরুতে কিছুই ছিল না, কেবল Chronos (Time) ও Chaos (শূন্যতা)। তার মধ্য থেকে জন্ম নেয় একটি দীপ্তিময় ডিম (Orphic Egg)। সেই ডিম ভেঙে জন্ম নেয় Phanes — যিনি সৃষ্টি করেন সবকিছু। এখানে "Phanes" ≈ "ব্রহ্মা" বা “প্রথম সৃষ্টিকর্তা”র প্রতিরূপ।
এটি অনেকটা potential → actuality তত্ত্বের মতো। জল ছিল potential substance, বীজ সঞ্চারে তা actual universe হয়ে ওঠে। আজকের পদার্থবিজ্ঞান বলে, শূন্যতা আসলে শূন্য নয়। Quantum Vacuum-এর মধ্যে থাকে virtual particles, যেগুলো ক্রমাগত তৈরি হয়, আবার বিলীন হয়। বিজ্ঞানীরা বলেন, এখানেই লুকিয়ে আছে Potential for Everything — ঠিক যেমন শাস্ত্রে বলা হয় “অব্যক্ত” বা “অচিন্ত্য”।এখনও পর্যন্ত আমাদের কাছে Big Bang-এর আগে কিছু নেই। কিন্তু শাস্ত্র বলে, সেই Nothingness-ও আসলে সব কিছুই।
বিজ্ঞান আজও উত্তর খুঁজছে — “সৃষ্টির আগে কী ছিল?” শাস্ত্র বলে, আগে ছিল এক অব্যক্ত সম্ভাবনা। এক “Potential Substance”, যা নিজেই নিজেকে প্রকাশ করে। আধুনিক বিজ্ঞান যেটাকে বলে: Singularity, Big Bang তা-ই আমাদের পূর্বপুরুষরা রূপক ও কাব্যিক ভাষায় ব্যাখ্যা করেছিলেন।
এই "বীজমবাস্তজহ" তাই শুধু ধর্মীয় ধারণা নয়, বরং আমাদের কাছে আজও এক চিরন্তন রহস্য — যা বিজ্ঞানের অঙ্কেও মাপা যায় না, অথচ অনুভবে স্পর্শ করা যায়।
Comments
Post a Comment